অবসর ভাবনা (হোম কোয়ারেন্টাইন)-ফা: তিতুস মৃ
“আমাদের প্রবৃত্তি কিনা বাইরের দিকে ছুটবার জন্যে সহজেই প্রবল” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু আমরা এখন গৃহ বন্দী। নিজ বাড়ীতে আটকা পড়ে আছি। মহামারী করনা ভাইরাসের সংক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এই সতর্কতা। নিজের বাড়ী আমাদের কাছে অতি প্রিয় একটি জায়গা বা স্থান, নিরাপদ আশ্রয়, সস্তির ঠিকানা। প্রিয় জায়গায় থাকতে কারো কোন আপত্তি নেই । কিন্তু আমরা অনেককে বলতে শুনি, গৃহে বন্দী থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গেছি। আর ভালো লাগে না।বাইরে যাবার জন্য মন ছটপট করছে।
প্রিয় স্থানে অবস্থান করেও কেউ যখন বিরক্ত হয় ব্যাপারটাকি অদ্ভুদ নয়?যেন মনে হয় ঘরের বাইরেই রয়েছে মুক্তির আনন্দ, স্বাধীনতা ও ভালো লাগা। সত্যিই কি তাই?
হোম কোয়ারেন্টাইনএই শব্দটার সঙ্গে বর্তমান সময়ে আমরা খুবই পরিচিত যার অর্থ হলো: নিজেকে পৃথক করে রাখা, আলাদা করে রাখা, জনসমাগম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, ঘরে আবদ্ধ থাকা।
যদি মুক্তি চাই তবে বাইরে বের হতে হবে। গণ্ডিবদ্ধ জীবনে আসলে মুক্তি নেই।অবশ্য এমন কেউ কেউ আছে যারা নিজস্ব গণ্ডিতেই থাকতে ভালোবাসে। সেই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই না! সেটা তার ভালো লাগা। তার স্বাধীনতা। একে সংকীর্নতাও বলা চলে। সংকীর্ন মনে বেশি মানুষের স্থান নেই। সেখানে বেশি জায়গা ধরে না। অনেক মানুষের জীবন এমন সংকীর্ণ যেখানে বেশি মানুষের স্থান নেই।
সেই সংকীর্ন গণ্ডি অতিক্রম করতে পারলে আমরা আরো স্বাধীন, মুক্ত; আনন্দিত মানুষ হতে পারবো।
স্নেহে বন্দী, প্রেমে বন্দী, কারাগারে বন্দী কোন বন্দীত্বই ভালো নয় আসলে। । বন্দীত্ব মানে সীমাবদ্ধ জীবন। সীমানার বাইরে যাওয়া নিষেধ। স্বাধীনতা সেখানে বাধাপ্রাপ্ত। তাই বেশি দূর যাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের জীবন তো এত সংকীর্ণ নয়, এত ছোট নয়, এতো ক্ষুদ্র নয় যে ঘরের কোণে পড়ে থাকবো, স্বার্থপর ভাবে শুধু নিজের কথা চিন্তা করবো; অন্যের কথা ভাববো না!
আমাদের যেতে হবে অনেক দূর! সীমানাকে করতে হবে বিস্তৃত । প্রাণভরে আলো বাতাস নেওয়ার মতো জায়গা দরকার আমাদের। কিভাবে পাবো সে সুযোগ? কোথায় পাবো সে সুবিধা? কে দেবে সে অধিকার? তা তৈরী করতে হয়।
আমরা বাইরে যাই কিসের জন্যে? কাজ করতে। ঘুরতে। আলো বাতাস পেতে। প্রয়োজন আছে বলে। প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া আমাদের অনেক প্রয়োজন মেটাই, জীবনের অনেক ঘাটতি পূরণ করে। বাইরে গেলে প্রয়োজনীয় কাজ তো হয়ই, শরীরও ভালো থাকে মনও চাঙ্গা থাকে।এই গৃহবন্দী সময়ে আমরা এটা বেশি করে অনুভব করছি। তবে বাইরে আমরা যাই নির্দিষ্ট কাজ সমাধা করতে। কাজ শেষে যেখানে ফিরে আসি সেটা হলো আপন গৃহ। নিজের বাড়ী। নিজের আবাস। অতি প্রিয় স্থান। নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু এই নিরাপদ আশ্রয়ে আমরা শান্তিতে বিশ্রাম করতে পারি তখনই যখন বাইরের কাজ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করি, আয় উপার্জন করি, বাইরে থেকে কিছু আনি। না হলে এমনি এমনিতে বাইরে গেলে কোন লাভই হয় না আসলে। বাইরে গেলেই যদি সব কাজ হয় তবে বাইরে থাকলেই তো চলে! কিন্তু তা তো হবার নয়!বাইরে যতই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হোক ভিতরের কাজ হলো মূল্যবান। ঘরে শান্তিতে বিশ্রাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে সময় দেওয়া অনেক দরকারি বিষয় ।সুরক্ষার জন্যে, বিশ্রামের জন্যে; শান্তির জন্যে স্বস্তির জন্যেভিতরে আসতেই হবে আমাদের।
ঘরে থাকলে কি কোন কাজ হয়?
যার ঘরে থাকার কথা সে ঘরে থাকুক, যে বাইরে যাবার সে বাইরে যাক! বাইরের কাজ বাইরেই ভালো। ভিতরের কাজ ভিতরে। বাইরের কাজ অনেক সময় বাড়িতে আনলে সমস্যা হয়। বাড়িতে কত কাজ থাকে। যারা বাড়ির কাজ করে তারা জানে। হোম কোয়ারেন্টাইন আমাদেরকে এসব বিষয়ে চিন্তা করতে সুযোগ করে দিচ্ছে। বাইরে যেহেতু বর্তমানে কাজ নেই তাহলে তো আমরা বাড়ির কাজ করতে পারি! নাকি অলসতায়, অযথায় সময় কাটিয়ে দিবো? যারা বলে যে করার কিছু নেই তারা বড় দুর্ভাগা! কে বলে যে করার কিছুই নেই? অনেক কিছুই করার আছে। বাড়ির আশপাশে এটা সেটা লাগানো, সবজী চাষ, জঙ্গল পরিষ্কার করা, যত্ন নেওয়া অনায়াসেই করা যায়।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে তুমি কিভাবে সময় অতিবাহিত করছ?
আমি বলবো আমার একটা নির্দিষ্ট রুটিন আছে। সময়ের ভাগে ভাগে আমি চলি। সকাল ৫ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমার কাজ আছে। বর্তমান সময়ে আমার বাইরে যেতে হয় না কোন কাজে। এটা আমার জন্য একটা লাভ। আমি সুযোগ পাচ্ছি নিজেকে গুছানোর।নিজের অনেক কিছুই তো অগোছালো, যেমন গুছিয়ে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে না পারা, ইংরেজীতে পারদর্শিতার অভাব, বুদ্ধির জড়ত্ব। এ সমস্ত বিষয় থেকে উদ্ধার পেতে বই পড়া, চর্চা করা, সাধনা করা, লেখার অভ্যাস গড়ে তোলা, ফুলের বাগান করা, সবজী চাষ করা এগুলো করতে করতে কখন দিন শেষ হয়ে যায় টেরই তো পায়না! সময় কাটে না বলার কোন সুযোগ আছে কি? কত কিছুই তো জানি না!বার বার পড়ার মতো কত বই আছে আমার টেবিলে তারপরও তো অনেক বই পড়াই হয়নি!
অবসর সময় হলো জীবনের লক্ষ্য স্থির করার ও কাজে লাগানোর উত্তম সময়। নিজেদেরকে আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আমি কি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আছি? প্রতিদিন আমি কি চিন্তা করি? কি পড়ি? কি বলি? কি চাই? কি করি? অন্যের জীবনে আমি কি একজন আদর্শ ব্যক্তি? আমি কি মোবাইলের অপ ব্যবহার করি? আরো সচেতনাতা দরকার কি?আমি কিভাবে উন্নতি করতে পারি?
নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নত করা দরকার। ইতিবাচক দিকগুলো বৃদ্ধি করে, ভালো কাজে ব্যস্ত থেকে সময়কে অর্থপূর্ণ করা যায়। অবসর সময়টুকু যেন বৃথা না যায়। শুধু মাত্র লুডু খেলে, ঘুমিয়ে সময় পার করার কোন যৌক্তিকতা নেই। অবসর সময়ে বই পড়ার অভ্যাস তৈরী করা যায়। গল্প, উপন্যাস; প্রবন্ধ কত ভাবে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারে!
নিজেকে গড়। নিজেকে তৈরী কর। নিজেকে সাজাও।
কিভাবে?
দক্ষ হয়ে।
পরিশ্রম করে।
সাধনা করে।
সচেতন হয়ে।
আমার জীবনের লক্ষ্য হলো উন্নতি করা। এগিয়ে যাওয়া, সমৃদ্ধ হওয়া, শিক্ষা গ্রহণ করা। স্বর্গ রচনা করা। প্রতিদিন আমি কি সে পথে অগ্রসর হচ্ছি? আমার মন প্রাণ কিসে নিবিষ্ট? আমার ধ্যান প্রার্থনা সাধনা কি? আমি নিশ্চয়ই অন্যদের জন্য ভালো ভালো উপদেশ দেই। আমি কি আমার জীবনে তা প্রয়োগ করি? কাজে লাগায়? কোন কিছু করার চেয়ে হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তুমি একটা কিছু হও। ভালো গাড়ি চালক হও, ভালো ছাত্র হও, ভালো গায়ক হও; ভালো বাদক হও; ভালো শিল্পী হও, ভালো লেখক হও, দক্ষ শ্রমিক হও, যা কিছুই হও না কেন কোন কিছুকে অবলম্বন করে বড় হও। অবসর সময় হোক আনন্দময়, সৃষ্টিশীল; অর্থপূর্ণ।
No comments